শিবলিঙ্গের উৎপত্তি ও ইতিহাস | আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি

আপনি কি শিব প্রতীকের ইতিহাস ও তাৎপর্য জানতে চান? তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকের আর্টিকেলটিতে শিবলিঙ্গের উৎপত্তি ও ইতিহাস সে সম্পর্ককে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাই শিব প্রতীকের উৎপত্তি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
শিবলিঙ্গের উৎপত্তি ও ইতিহাসের প্রতীকী ছবি
নিচে আপনাদের জন্য শিবের প্রতীকী রূপের ইতিহাস ও উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেখান থেকে আপনি খুব সহজেই শিবলিঙ্গের উৎপত্তি ও ইতিহাস জানতে পারবেন। তাই দেরি না করে শিবলিঙ্গের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নিন।

ভূমিকা

হিন্দু ধর্মে "শিবলিঙ্গ" একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক প্রতীক। এটি কেবলমাত্র একটি পূজার বস্তু নয়, বরং সৃষ্টি, ধ্বংস ও পুনর্জন্মের মহাজাগতিক ধারার প্রতিচ্ছবি। এই প্রবন্ধে শিবলিঙ্গের উৎপত্তি ও পূজার বিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

শিবলিঙ্গ কী ও এর প্রতীকী অর্থ

এই লিঙ্গ প্রতীক বিশাল আধ্যাত্মিক দর্শন ও শাশ্বত সত্যের প্রতীক, যার আদি নেই অন্ত নেই ঠিক যেমন ভগবান শিবের চেতনা। এটি শুধু একটি পাথরের মূর্তি নয়।

  • "লিঙ্গ" শব্দের অর্থ — “চিহ্ন” বা “প্রতীক”। এটি একটি সংস্কৃত শব্দ। তাই শিবলিঙ্গ মানে শিবের “প্রতীক” বা “চিহ্ন” যা সৃষ্টি ধ্বংস ও পুনর্জন্মের চক্রকে বোঝায়। লিঙ্গ প্রতীক সাধারণত তিনটি অংশে বিভক্ত থাকে নিচের অংশ (ব্রহ্ম ভাগ), মধ্য ভাগ (বিষ্ণু ভাগ), উপরের গোলাকৃতি অংশ (শিব ভাগ)। ব্রহ্ম ভাগ যা সৃষ্টিকে প্রতীক করে, বিষ্ণু ভাগ স্থিতি বা রক্ষা নির্দেশ করে এবং শিব ভাগ যা ধ্বংস বা রূপান্তর বোঝায়। এই তিনটি ভাগ ত্রিদেবের কার্যধরার প্রতীক, যা সৃষ্টির চক্রকে বোঝায় এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু ও শিবকে একত্রে ত্রিনাথ বা ত্রিমূর্তি বলা হয়।
  • নিরাকার শিবের প্রতীকী রূপ ও সৃষ্টির প্রতীক। ভগবান শিবের কোন আকার নেই, তিনি নিরাকার। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃশ্যমান নয় কিন্তু মহাবিশ্বের সবকিছু ধারণ করে এই শিবলিঙ্গ যাকে নিরাকার ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। জ্যোতির্লিঙ্গকে সৃষ্টি ও মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অনেক শাস্ত্রে। “ন রূপং তস্য শোভনম” অর্থাৎ শিবের কোনও নির্দিষ্ট রূপ নেই। তিনি অনন্ত, অরূপ, অবিনাশী আর সেই নিরাকার উপাসনার মাধ্যম এই শিবলিঙ্গ।
  • শক্তি (দেবী) ও চেতনার (শিব) মিলন বোঝায়। শুধু, পুরুষ শক্তির প্রতীক নয় শিবলিঙ্গ। লিঙ্গ মানে চেতনার প্রতীক (পুরুষ) আর যোনি মানে শক্তি বা প্রকৃতি (নারী), যা শক্তি ও প্রকৃতির একত্রে মিলনকেই নির্দেশ করে যেখান থেকে সমস্ত সৃষ্টির উৎপত্তি। এটি মূলত জীব ও জগতের জন্মসূত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অনেক শিবলিঙ্গের নিচে থাকা গোল থালা বা যোনি অংশ মা পার্বতীর (শক্তি) প্রতীক, যা এই সমন্বয়কে প্রতিফলিত করে।

শিব পুরাণে শিবলিঙ্গের আত্মপ্রকাশ

একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে কে বড় এই প্রশ্নে তর্ক হলে, শিব অসীম অগ্নিস্তম্ভরূপে প্রকাশ পান। এরই চূড়া বা মূল কেউ খুঁজে পায় না — এটিই লিঙ্গ প্রতীকের সূচনা আর সেই থেকে শিবকে অনাদি-অনন্ত রূপে লিঙ্গরূপে পূজা করা হয়। যখন ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তখন এটি এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড অস্থির হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই আকাশ ভেদ করে এক বিশাল আলো স্তম্ভ মাটিতে নেমে আসে যার শেষ বা শুরু দেখা যাচ্ছিল না। শিবের এই রূপ ছিল অনন্ত, অনাদি, অপ্রাকৃত।

"যে আমার এই রূপের শুরু বা শেষ খুঁজে পাবে, সে-ই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে।" শিব এই কথাটি বললেন। তখন বিষ্ণু নিচের দিকে গিয়ে খুঁজতে লাগলেন সেই স্তম্ভের মূল এবং ব্রহ্মা উপরের দিকে উঠতে লাগলেন স্তম্ভের শুরু খোঁজার জন্য। কিন্তু কেউ এর শুরু বা শেষ খুঁজে পেলেন না এই দ্বন্দ্ব বিনাশের সূত্র ধরেই মূলত শিবলিঙ্গের সূচনা। "লিঙ্গ রূপধারী দেবঃ সর্বলোক পিতামহঃ। তস্য পূজা চ লিঙ্গেষু সম্যক ফলদায়িনী॥" অর্থাৎ যিনি লিঙ্গরূপ ধারণ করেন, তিনি সর্বলোকের পিতা। লিঙ্গে শিবের সঠিক পূজা করলে তা অতি ফলদায়ক হয়।

অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে শিবলিঙ্গের উল্লেখ

স্কন্দ পুরাণ ও লিঙ্গ পুরাণে জ্যোতির্লিঙ্গের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। “লিঙ্গং মূর্ত্যামূর্তম চৈকং, নিদানং যোগ্যপূজিতম।শিবস্যাত্মা মহাদেবঃ, সর্বলোকৈঃ সনাতনঃ॥" এর অর্থ হলো : লিঙ্গ হল শিবের এমন এক রূপ যা মূর্ত এবং অমূর্ত উভয়ই —এটি সকল সৃষ্টির মূল এবং যোগ্যভাবে পূজার যোগ্য। এই লিঙ্গরূপই মহাদেব শিবের আত্মপ্রকাশ, যিনি চিরন্তন ও সর্বজগতের অধীশ্বর। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে শিবের প্রকাশ এক অনল-জ্যোতি স্তম্ভ হিসেবে হয় এবং তিনি বলেন — “আমার কোনও আদি নেই, অন্ত নেই। আমিই সনাতন সত্তা।” মূলত ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে জ্যোতির্লিঙ্গের উৎপত্তি হয়েছে। এই আলো স্তম্ভই পরবর্তীতে শিবলিঙ্গে রূপান্তরিত হয়।

বৈদিক যুগে ‘যজ্ঞ’ ও ‘অগ্নি’ এর রূপক ছিল শিবলিঙ্গের প্রাথমিক রূপ। শিবলিঙ্গকে "সৃষ্টি, সংহার ও নির্বাণ"-এর একাত্ম রূপ বলা হয়েছে লিঙ্গ পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্মসংহিতা ইত্যাদি গ্রন্থে। এখানে পুরুষ সত্তা ও চেতনাশক্তির প্রতীক হয়েছে ‘অগ্নি’ এবং সৃষ্টির ক্রিয়া ও ত্যাগের রূপক হিসেবে রূপ পেয়েছে ‘যজ্ঞ’। শিবলিঙ্গের উচ্চভাগ চেতন বা ব্রহ্মের প্রতীক, মধ্যভাগ সৃষ্টি ও নিম্নভাগ যোনি (প্রকৃতি বা আধার) যা অনেকটা যজ্ঞের বেদি ও অগ্নিকুণ্ডের প্রতিচ্ছবি। বৈদিক যুগে যজ্ঞ ছিল সৃষ্টি, পুনর্জন্ম ও ত্যাগের প্রতীক এবং অগ্নি ছিল দেবতাদের দূত। যজ্ঞ ছিল গোটা বৈদিক ধর্মাচরণের কেন্দ্রবিন্দু এবং অগ্নির মাধ্যমে যজ্ঞানুষ্ঠান ও হোম-আহুতি দেবতাদের নিকট পৌঁছাতো।

ইতিহাস ও শিবলিঙ্গ পূজার বিবর্তন

মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা (সিন্ধু-সরস্বতী) সভ্যতায়ও শিবলিঙ্গের মতো প্রতীক পাওয়া গেছে। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায় (৩০০০–১৫০০ খ্রি.পূ.) প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এমন কিছু পাথরের বস্তু পাওয়া গেছে যেগুলিকে অনেক গবেষক প্রাথমিক শিবলিঙ্গ বলে মনে করেন। তন্ত্রসাহিত্যে শিব ও শক্তির মিলনকে কুণ্ডলিনী জাগরণের রূপে দেখা হয়। বৈদিক যুগে (১৫০০–৫০০ খ্রি.পূ.) রুদ্র’ নামক দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে, যিনি ছিলেন গম্ভীর, তীব্র, ধ্বংসকারী শক্তির অধিকার। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই “রুদ্র” দয়ালু ও সর্বজ্ঞ “শিব” রূপে বিকশিত হয়। পুরাণ অনুযায়ী, শক্তি ছাড়া শিব নিষ্ক্রিয়। তাই লিঙ্গের ভিত্তিতে যোনিপীঠ থাকে, যা প্রকৃতির বা মাতৃশক্তির প্রতীক। তবে এই সময় লিঙ্গরূপে পূজার কোনো উল্লেখ নেই।

কালক্রমে বিভিন্ন শৈব মন্দিরে শিবলিঙ্গ পূজা নিয়মিত রীতি হয়ে ওঠে। লিঙ্গ প্রতীক পূজাকে রাজধর্মরূপে প্রচলিত করে এবং বিখ্যাত মন্দির নির্মাণ করে (যেমনঃ তামিলনাড়ুর বৃহদীশ্বর মন্দির) দক্ষিণ ভারতের চোল রাজারা। বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দির, রামেশ্বরম, উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর, অমরনাথ গুহায় প্রাকৃতিক বরফলিঙ্গ এবং কেদারনাথসহ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয় এই সময় থেকেই। শিবলিঙ্গকে যৌন প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন ইংরেজ ও কিছু পাশ্চাত্য পণ্ডিত। তবে এর আধ্যাত্মিক ও দর্শনগত ব্যাখ্যা—যেখানে শিবলিঙ্গ "নিরাকার ঈশ্বরের" রূপক এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় পণ্ডিতেরা (যেমনঃ স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী সারদানন্দ)। সোমবার ব্রত, শিবরাত্রি, মহাদশমী তিথিতে শিবলিঙ্গ পূজার চল সুপ্রচলিত। শহরের মহাশিবরাত্রি থেকে শুরু করে গ্রামের প্রাচীন শিবালয় পর্যন্ত লিঙ্গপূজা আজও সমান গুরুত্ব ও আধ্যাত্মিক আবেগে প্রচলিত।

দক্ষিণ ভারতে ড্রাভিডীয় শৈলীতে লিঙ্গ-পূজার বিশেষ বিস্তার ঘটে। ড্রাভিডীয় শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মন্দিরগুলোর গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গের স্থাপন ও পূজা। শিবলিঙ্গ নিরাকার ব্রহ্মতত্ত্বের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত থাকে ড্রাভিডীয় মন্দিরগুলোর সর্বোচ্চ পবিত্র স্থানে (গর্ভগৃহ)। তিরুভাঞ্জাইকলার মন্দির, মদুরাইয়ের মিনাক্ষী মন্দির, চিদাম্বরমের নটরাজ মন্দির প্রভৃতি এই অঞ্চলের বিখ্যাত মন্দির, যেখানে লিঙ্গ-রূপে শিবের উপাসনা প্রাধান্য পেয়েছে। লিঙ্গ হলো "সর্বত্র উপস্থিত পরমেশ্বরের" প্রতীক — যিনি রূপ ও অরূপের সীমা ছাড়িয়ে অনন্ত শক্তির আধার, এটি বলা হয়েছে লিঙ্গ পুরাণ ও শিব পুরাণে। একাম্বারেশ্বর, চিদাম্বরম, রামেশ্বরম, মহাবলীপুরমের মতো ভারতের বিখ্যাত তীর্থস্থানে এই প্রতীকী লিঙ্গপূজা গভীর আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত। জ্যোতির্লিঙ্গ পূজা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়; এটি শিল্প, ইতিহাস, শাস্ত্র ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের সমন্বিত রূপ।

উপসংহার

শিব প্রতীক কেবলমাত্র ধর্মীয় উপাসনার প্রতীক নয়, বরং, এটি সৃষ্টি ও চেতনার চিরন্তন মিলনের প্রতিফলন। হিন্দু ধর্মে এর গাম্ভীর্য ও তাৎপর্য যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি জাগিয়ে রেখেছে। এটি কালের সাক্ষী—যা বহন করে হিন্দুধর্মের গভীরতম আধ্যাত্মিক উপলব্ধি।

আশা করি আজকের আর্টিকেলটি পড়ে আপনি জানতে পেরেছেন হিন্দু ধর্মে শিবলিঙ্গের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। এ ধরনের আরও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফ্রিল্যান্সিং এক্সপ্রেস ইন্সটিটিউটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url